logo

স্মৃতির শুল্ক ( The Memory Tax )

স্মৃতির শুল্ক ( The Memory Tax )

ধারা: Social Sci-Fi / Dystopia

লেখক: আসফাক আলি খান (লালটু)

১. প্রস্তাবনা — "অতিরিক্ত স্মৃতি মানে অপরাধ"

সাল ২০৯৫।
বিশ্বব্যাপি অর্থনৈতিক মন্দা চরমে ,সরকার প্রতিটি নাগরিকের স্মৃতি ব্যবহারের উপর অতিরিক্ত শুল্ক( Tax on Memory Usage ) আরোপ করেছে ।
বিশ্বের অর্থনীতি এতটাই ধসে পড়েছিল যে “অবসাদ” ও “অতিরিক্ত চিন্তা” এখন রাষ্ট্রীয় অপরাধ।
মানুষ কেবল জরুরি বা গুরুত্বপূর্ন স্মৃতিগুলো সক্রিয় রাখতে পারবে ; বাকি স্মৃতিগুলো ' ( Dormant ) বা মুছে ফেলতে হবে । এটা সমাজের নিম্নবিত্তদের আরো কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে ।
মানুষের মস্তিষ্কে বসানো হয় Memory Meter —
যা পরিমাপ করে আপনি দিনে কতটা স্মৃতি ব্যবহার করছেন।
নিয়ম: প্রতিটি সক্রিয় স্মৃতির জন্য দিতে হয় ট্যাক্স।
অর্থাৎ, যতো বেশি আপনি মনে রাখবেন, তত বেশি শুল্ক।

সরকারি স্লোগান:

“যা অপ্রয়োজনীয়, তা ভুলে যাও —
শান্ত থাকো, সুস্থ থাকো, উৎপাদনশীল থাকো।”

মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তরা সহজে সামলায়।
কিন্তু নিম্নবিত্তের কাছে— স্মৃতিই তাদের একমাত্র সম্পদ।
তাই তারা সবচেয়ে বেশি ‘দোষী’।

২. রোমেল — নিয়মের সন্তান

রোমেল চক্রবর্তী, ৪৩ বছর বয়সী স্মৃতি-শুল্ক পরিদর্শক ( Memory Tax Inspector)
সে কঠোর নিয়মতান্ত্রিক, শান্ত, এবং সর্বদা কর্তব্যপরায়ণ। কিন্তু তার গোপন দুর্বলতা হলো, সে তার মৃত স্ত্রীর কিছু স্মৃতি মুছে ফেলতে পারেনি, যা অবৈধ ।

তার টেবিলের ওপর ঝলমল করে সরকারী ব্যাজ —
“Ministry of Cognitive Regulation”।

প্রতিদিন সকাল দশটায় সে বাড়ি বাড়ি যায়,
স্মৃতি মিটার স্ক্যান করে, এবং বলে —
“আপনার মস্তিষ্কে ১২৩% অতিরিক্ত ডেটা জমেছে, অনুগ্রহ করে মুছে ফেলুন।”

তবু রাতে রোমেল মানুষ হয়ে ওঠে।
তখন সে খোলে তার গোপন ড্রয়ার।
সেখানে লুকানো একটি স্মৃতি ক্যাপসুল,
যার মধ্যে সংরক্ষিত আছে একমাত্র নিষিদ্ধ স্মৃতি —
তার মৃত স্ত্রী মীনার গান।

রোমেল জানে,
এই স্মৃতির জন্য তাকে ট্যাক্স দিতে হলে সারাজীবনের উপার্জনও যথেষ্ট নয়।
তবু সে গোপনে সেটি চালায়।
হালকা কণ্ঠে মীনা গায়—

“মেঘ পেরিয়ে যদি ফিরে আসো, মনে রেখো, আমি আছি।”
এই স্মৃতি তাকে মাঝে মাঝে মানবিক করে তোলে ।
সেই গানই রোমেলকে এখনো মানুষ রাখে।

৩. নন্দিনীর ঘর — গল্পের অপরাধ । তিনি প্রবীণ নিম্নবিত্ত নারী ,তিনি তার নাতি নাতনিদের কাছে পরিবারের পুরনো দিনের গল্পঃ বলার জন্য অবৈধ ভাবে স্মৃতি সঞ্চয় করে রেখেছেন । তিনি মনে করেন , স্মৃতিই মানুষের আসল সম্পদ ।

একদিন হেড অফিস থেকে বার্তা আসে:

“Citizen ID: NND-71. Excess Memory Usage: 386%
Inspection Required — Inspector Romel Chakraborty.”

নন্দিনীর স্মৃতি - মিটার অতিরিক্ত সংকেত দেয় ।
রুমেল কে নির্দেশ দেওয়ায় তার বাড়ি গিয়ে অতিরিক্ত স্মৃতি গুলো মুছে ফেলার ।

নির্দেশ অনুযায়ী রোমেল যায় শহরের পুরোনো অঞ্চলে।
এক তক্তার ঘর, ছাদের ফাঁকে সূর্যের রেখা,
চারপাশে পুরোনো বই, টেপ রেকর্ডার, কাঠের পুতুল।

সেখানে বসে আছেন নন্দিনী দেবী —
এক বৃদ্ধা, যার চোখে অদ্ভুত আলো।

রোমেল মেশিন চালায়।
মিটার তীব্র শব্দ তোলে — “Memory Overload Detected.”

“আপনার স্মৃতি-ডেটা আইন লঙ্ঘন করছে,” রোমেল জানায়।
“নির্দেশ অনুযায়ী, অপ্রয়োজনীয় স্মৃতিগুলো মুছে ফেলতে হবে।”

নন্দিনী শান্তভাবে বলেন,
“অপ্রয়োজনীয় স্মৃতি মানে কী, বাবা?
এই গল্পগুলোতে আমার মা, আমার গ্রামের হাট,
আমার ছোটবেলার পালাগান— এগুলোই তো আমার জীবন।”

তার পাশে বসা দুটি শিশু ফিসফিস করে—
“ঠাকুমা আজকে মহুয়া সুন্দরীর গল্প বলবে।”

রোমেল থমকে যায়।
এক মুহূর্তে সে অনুভব করে— এই গল্পগুলোই একদিন তার স্ত্রীও বলত।
এই ঘর যেন অতীতের সুগন্ধে ভরা এক প্রতিবাদ।
রুমেলের মনে হলো এটা শুধু পারিবারিক স্মৃতি নয়, বরং হারিয়ে যাওয়া লোক - ঐতিহ্যের অসংখ্য গল্পঃ ও গান মনে করে রেখেছেন ।
নন্দিনী দাবি করেন , আমার মাথায় যত গল্পঃ ও গান আছে ততো শুল্ক দিতে হবে ? গল্পঃ , কবিতা কি বিলাসের বস্তু ?

৪. ড. অরূপ সেন — ( প্রযুক্তির অনুশোচনা ) সেই বিজ্ঞানী,যিনি এই ' স্মৃতি - শুল্ক -প্রযুক্তি ' তৈরি করেছিলেন ।তিনি এখন অনুতপ্ত এবং গোপনে স্মৃতি - সঞ্চয়ের একটি ভুগর্ভস্থ গ্রন্থাগার ( Underground Library) পরিচালনা করেন ।
এখন তিনি নন্দিনী কে রক্ষা করতে এসেছেন ।

গল্পঃ শুরু হয় রুমেলের দৈনন্দিন কাজ দিয়ে -- নাগরিকদের স্মৃতি মিটার পরীক্ষা করা। সরকার যুক্তি দেয় যে, অতিরিক্ত স্মৃতি সঞ্চয় মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা কমায় এবং পরিবেশের উপর চাপ ফেলে ,তাই তাই এই শুল্ক জরুরি। বাস্তবে এটি নিম্নবিত্তদের সাংস্কৃতিক ইতিহাস ভুলিয়ে দিয়ে সহজে নিয়ন্ত্রণ করার একটি কৌশল ।

রোমেল রিপোর্ট পাঠাতে যাবে, ঠিক তখনই দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করেন এক ধূসর কোট-পরা মানুষ।
তিনি বলেন,
“আমি ড. অরূপ সেন।
আমি সেই প্রযুক্তির আবিষ্কারক, যা এখন এই শুল্কের মাপকাঠি।”

রোমেল বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে।
এই নাম তো সরকারী রেকর্ড থেকে মুছে গেছে!

ড. সেন ধীরে বলেন,
“আমি ভেবেছিলাম মানুষের স্মৃতি সংরক্ষণ করে তাকে সুস্থ রাখা যাবে।
কিন্তু তারা এটাকে ব্যবসা বানিয়ে ফেলেছে।
এখন আমি এক ‘ভূগর্ভস্থ স্মৃতি-গ্রন্থাগার’ চালাই—
যেখানে সংরক্ষিত আছে কোটি কোটি মানুষের মুছে ফেলা স্মৃতি।”

নন্দিনী বলেন,
“আমার সব গল্প, সব গান ওইখানে পাঠিয়ে দাও, ডাক্তারবাবু।
হয়তো কোনো একদিন কেউ সেগুলো আবার শুনবে।”

মিশন শুরু : রুমেল , ড. সেন ও নন্দিনীকে ভূগর্ভস্থ ' স্মৃতি - গ্রন্থাগার - এ প্রবেশ করেন , সেখানে একটি গোপন দরজা আছে । সেখানে সমাজের কোটি কোটি মানুষের মুছে ফেলা স্মৃতি বা ত্যাগ করা স্মৃতিগুলি সংরক্ষিত আছে ।তাদের লক্ষ্য হলো সেই লুকানো দরজা দিয়ে তথ্য গুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করা ।

রোমেলের ভিতরে দ্বন্দ্ব জাগে।
তার কর্তব্য বলে— “এরা অপরাধী।”
কিন্তু মীনার কণ্ঠ যেন ফিসফিস করে—

“যদি ভুলে যাও ভালোবাসা, তবে মানুষ রইলে কোথায়?”

৫. ভূগর্ভস্থ যাত্রা — “স্মৃতি-গ্রন্থাগার”

রাতের শহর নিস্তব্ধ।
তিনজন চুপিচুপি নেমে যায় পরিত্যক্ত সাবওয়ে টানেল ধরে।
শেষে পৌঁছে এক বিশাল কক্ষ—
দেয়ালজুড়ে অসংখ্য আলোকিত গোলক ভাসছে।

প্রতিটি গোলক একটি স্মৃতি।
একজন কৃষকের হাসি,
একজন প্রেমিকার চোখের জল,
একটি মায়ের ল lullaby— সব কিছুই সেখানে বন্দী।

ড. সেন বলেন,
“এই সার্ভারের মধ্যেই আছে ‘The Door’—
একটি কোড যা খুললে সমস্ত মুছে ফেলা স্মৃতি ফিরে আসবে।”

রোমেল জিজ্ঞেস করে, “তাহলে শুরু করি?”

* পুনরুদ্ধার ও পরিণতি ( The Retrieval and Consequence )

৬. স্মৃতির যুদ্ধ

রোমেল নিজের সরকারি প্রশিক্ষণ কাজে লাগায়।
কনসোলে টাইপ করে— Access: Romel_Inspector_ID. Override Protocol.

হঠাৎ স্ক্রিনে ভেসে ওঠে সতর্কবার্তা—
“Unauthorized Access Detected.”
উপরে ড্রোনের আলো জ্বলে ওঠে।

রুমের তার পরিদর্শকের প্রশিক্ষিত জ্ঞান ব্যবহার করে সরকারি স্মৃতি - নিয়ন্ত্রণ সার্ভার কে হ্যাক করার চেষ্টা করেন । এই হ্যাকিংয়ের ফলে মানুষের মস্তিষ্কে সাময়িক বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় ।
ড. সেন চিৎকার করেন, “এখনই Door খুলে দাও!”
রোমেল শেষ কোড ইনপুট করে:

RETRIEVE_ALL()

এক মুহূর্তে সিস্টেম কাঁপে।
তারপর… নিস্তব্ধতা।
তারপরেই শুরু হয় এক অদ্ভুত ঝড়।

শহরের প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি মাথা,
একসঙ্গে আলো ছড়াতে শুরু করে।
একেকজনের স্মৃতি আরেকজনের মনে চলে আসে । এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে রুমেল তার স্ত্রীর সেই গোপন গানটি স্মৃতি - সার্ভারে খুঁজে পায়।
একজন অচেনা যুবক হঠাৎ মনে করে তার হারানো বাবাকে।
এক বৃদ্ধা গুনগুন করে সেই পুরোনো বাউল গান।
এক শিশুর মনে জেগে ওঠে তার জন্মদিনের প্রথম মোমবাতি।

মানুষ একে অপরের চোখে দেখে নিজের অতীত।

রোমেল অনুভব করে— তার ভিতরে মীনার গান ভাসছে,
কিন্তু এবার সে একা শুনছে না—
সারা শহর গাইছে সেই গান।
সে সিদ্ধান্ত নেয় , ব্যক্তিগত স্মৃতি নয় ,সমাজের ভুলে যাওয়া ইতিহাস পুনরুদ্ধার করায় বেশি গুরুত্বপূর্ন ।
রুমেল সফল ভাবে মুছে ফেলা স্মৃতিগুলোকে মুক্ত করে দেয় । মুহূর্তের মধ্যে সারা দেশে মানুষ তাদের ভুলে যাওয়া ইতিহাস , সংস্কৃতি এবং আবেগের স্মৃতি ফিরে পায় । ডিষ্টপিয়ান সিস্টেম ভেঙে পড়ে ,

৭. ড্রোনেরা অবশেষে নেমে আসে।
রোমেল, নন্দিনী ও ড. সেনকে আটক করা হয়।
তবু তারা হাসে— কারণ কাজ শেষ।

মানুষের মনে এখন ফিরে এসেছে তাদের হারানো অতীত,
তাদের সংস্কৃতি, তাদের ভালোবাসা।
স্মৃতির শুল্কের সিস্টেম ভেঙে গেছে।

রোমেল চোখ বুজে শোনে—
দূরে কোথাও কেউ গাইছে সেই লোকগান,
যা কোনোদিন কেউ শোনেনি, তবু সবার হৃদয়ে ছিল—

“মুক্ত আকাশের নিচে,
আমি আবার মনে রাখব,
আমি ভুলে যাব না।”

--------------------------------
* থিম , ব্যাখ্যা ও গল্পের বিশেষত্ব ( Thim, Explanation and Uniqueness )

দিক --- প্রতীকী অর্থ

স্মৃতি শুল্ক -- রাষ্ট্রের তথ্য-নিয়ন্ত্রণ; ইতিহাস মুছে ফেলার রাজনীতি

সাংস্কৃতিক ডিসটোপিয়া -- এটি কেবল অর্থনৈতিক বৈষম্য নয় বরং স্মৃতির অধিকার এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিলাদের পণ্য হিসেবে দেখা বিপদ নিয়ে প্রশ্ন তোলে ।

বিজ্ঞান ও আবেগ -- প্রযুক্তির চরম ব্যবহার এবং তার বিপরীতে মানুষের মৌলিক আবেগ ও লোক - ঐতিহ্যের সংগ্রাম তুলে ধরা

রুমেল -- নৈতিক ধূসরতা , রুমেল নিজেই সিস্টেমের অংশ । তার ব্যক্তিগত দুর্বলতা ( স্ত্রীর স্মৃতি ,) তাকে সিস্টেমের বিরুদ্ধে যেতে উৎসাহিত করে ,যা তার চরিত্র টিকে আরো গভীরতা দেয় ।

নন্দিনী --মৌখিক ঐতিহ্য, লোকসংস্কৃতি ও মাতৃস্মৃতি
রোমেল কর্তব্য আর মানবতার সংঘাত

ড. সেন --প্রযুক্তির নৈতিক অনুশোচনা

স্মৃতি- গ্রন্থাগার মানুষের সামষ্টিক চেতনা ও ইতিহাসের ভাণ্ডার

Door / Retrieval - মুক্তি ও স্মৃতির পুনর্জন্ম

* এক লাইনে সারমর্ম

“যে সমাজ নিজের স্মৃতি বিক্রি করে,
সে একদিন নিজের আত্মাও হারায় ।

22
49 views