logo

রামনগরের গর্ব পিয়ালী মাইতিকে সম্বর্ধনা জানালো উত্তর কচুয়া পূর্ব মেদিনীপুর জনকল্যাণ সংঘ।

রামনগরের গর্ব পিয়ালী মাইতিকে সম্বর্ধনা জানালো উত্তর কচুয়া পূর্ব মেদিনীপুর জনকল্যাণ সংঘ।

সাধারণ পরিবারে অসাধারণ প্রতিভা। তাজপুরের পিয়ালী মাইতি ( রাখী)

মেদিনীপুরের তাজপুর গ্রামের গর্ব ,,পিয়ালী মাইতি ওরফে রাখী

রং-তুলি নয়, স্বপ্নে আঁকা জীবন ছিল মেয়েটির ”।
আর রাখী রং তুলি নিয়ে আঁকতে চেয়েছিল ভবিষ্যৎ,

রঙ ছিল না, শিক্ষাগুরু ছিল না—তবু হৃদয়ে ছিল এক অসম্ভব আঁকার নেশা,
তাজপুরের ছোট্ট ঘরেই গড়ে উঠছে এক শিল্পীর স্বপ্ন জগত,

পিয়ালী মাইতি— যাকে সকলেই ভালোবেসে ডাকেন রাখী নামেই !

পূর্ব মেদিনীপুর জেলার রামনগরের সংলগ্ন এক ছোট্ট গ্ৰাম তাজপুরের বাসিন্দা, ছোট থেকেই খুব সাধারণ জীবন তাঁর। বাবা তপন কুমার মাইতি পেশায় কৃষি এবং সাথে একটি (প্রাইভেট কোম্পানীতে কর্মরত)। মা যুথী মাইতি গৃহিণী এবং সাথে তিনি একজন (মিটার রিডার) জিনি গ্ৰামে গ্ৰামে পায়ে হেঁটে ঘুরে মিটার দেখেন । অনেক কষ্টে গড়ে ওঠে মধ্যবিত্ত পরিবার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হল রাখী , মূল্যবোধ আর স্বপ্নে ছিল এক অনন্য দৃঢ়তা।

রাখীর জীবনে প্রথম যেটা এসেছিল, সেটা ছিল 'রং নয়, ইচ্ছা'। ছোটোবেলা থেকেই পেন্সিল হাতে কাগজে দাগ কাটতে কাটতে যে আনন্দ পেতেন, তা শহরের নামী কোনো আঁকিয়ের প্রশিক্ষণ ছাড়াই তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল এক সৃজনশীলতার জগতে,

কিন্তু যেটুকু স্বপ্ন ছিল, তাও আটকে ছিল অভাবের খাঁচায়।
না ছিল কোনো আর্ট স্কুল, না কোনো শিক্ষক, এমনকি সঠিক রং-তুলিও ছিল না হাতে। তবু প্রতিদিন একটু একটু করে আঁকতেন। চুপচাপ বসে, জানলার ধারে, কাগজের উপর মনের ছবি আঁকতেন। গ্রামের মাটির গন্ধ, নারকেল গাছের ছায়া, আর হৃদয়ের কল্পনার মেলবন্ধনে একেকটা ছবি যেন তাঁর অস্তিত্বের ছাপ হয়ে উঠত।

আরও একবার জীবন বাঁক নেয় ২০২০ সালে, যখন শুরু হয় লকডাউন।
চারপাশে বন্ধ সবকিছু। কিন্তু ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে তাঁর স্বপ্নটাও যেন আরও বেশি করে শব্দ তুলতে থাকে। দিনে যতটা সময় পড়াশোনা—কারণ তখন তিনি স্নাতকের ছাত্রী—বাকি সময়টা চলে যেত আঁকার খাতা আর পেন্সিল নিয়ে। তখনও কেউ জানত না, এই নিভৃত গ্রামের এক মেয়ে শিল্পের ভাষায় কথা বলতে শিখছে।

তবে বাধা এসেছে নানা দিক থেকে।
যখন কলেজ শেষের পথে, তখন শুরু হয় আত্মীয়-স্বজনের চেনা সুর—“এবার বিয়েটা হোক…”কি
কিছু গ্রামের লোকেদের একটা ভ্রান্ত ধারণা, গ্রামে মেয়েদের ভবিষ্যৎ মানেই তো বিয়ে। স্বপ্ন? ওটা গল্পের বইতেই পড়ে ভালো লাগে।
কিন্তু রাখী ঠিক করলেন, নিজের কাহিনি নিজে হতেই লিখবেন।

“স্বপ্ন তো নিজের, তাহলে সমাজকে ছেড়ে আমি হাঁটব কেন?”—এই ছিল তাঁর মনে জেগে থাকা সাহসী প্রশ্ন।

তাই চারপাশে বিয়ের পিঁড়ি সাজানোর তাগিদ থাকলেও, রাখী সাজাচ্ছিলেন নিজের রংতুলির জগৎ। ছবি আঁকাকে আঁকড়ে ধরলেন, আর তার সঙ্গেই জুড়ে দিলেন আরও এক সৃজনশীল পথ—গ্রামের ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের নাচ শেখানো। নাচ শেখানোটা যেন তাঁর দ্বিতীয় ভাষা। ছবি আর নাচ—এই দুটোই আজ তাঁর আত্মার পরম আশ্রয়।

আজ তিনি পেশাদার শিল্পী না হলেও, গ্রামের কাছে অনুপ্রেরণা। তাঁর আঁকা ছবিগুলো মেলা, স্থানীয় প্রদর্শনীতে যায়। অনেকেই তাঁর থেকে শেখার ইচ্ছে প্রকাশ করে। ছেলেমেয়েরা যেভাবে তাঁর কাছে নাচ শিখতে আসে, তা যেন প্রমাণ করে—শুধু শহরে নয়, প্রতিভার জন্ম গ্রামেও হয়।

আর এখানেই শেষ নয় তাঁর মানবিক রূপ।
তিনি একজন প্রাণীবন্ধু। প্রতিবছর নিজের জন্মদিনে গ্রামের কুকুর-বিড়ালদের জন্য খাবার ও ওষুধের ব্যবস্থা করেন। অনেকেই যখন পশুদের তাড়িয়ে দেয়, তখন রাখী তাদের আপন করে নেন। ভালোবাসেন, আগলে রাখেন, ঠিক যেমন ভালোবাসেন নিজের আঁকার খাতা।

এইভাবেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে রাখীর এক নিজস্ব জগৎ—যেখানে মাটির ঘ্রাণ, সংসারের চাপ, সমাজের রীতিনীতি—সব পেরিয়ে সে নিজের কল্পনার পৃথিবী গড়ে চলেছে।

যেখানে অন্যরা ভবিষ্যৎ ভেবে থেমে যায়, সেখানে রাখী ছবি এঁকে এগিয়ে চলে।
রাখি বুঝিয়ে দিয়েছেন,স্বপ্ন বড় হলে স্বপ্ন পূরণ করার সাহসটাও রাখতে হয়, আর পথ সেতো তৈরি হয় নিজে থেকেই। পিয়ালী মাইতি ওরফে রাখী সেই পথ তৈরি করছে নিজের হাতেই— না পাথরে, না রাস্তায়—ছবির পাতায় পাতায়।
তাঁর গল্প আজ তাজপুরের মাটি পেরিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে সেই সব তরুণ-তরুণীদের কাছে, যারা সমাজের চোখ রাঙানিকে পাত্তা না দিয়ে নিজের স্বপ্নে বিশ্বাস রাখে।

হ্যাঁ, রাখীর মতো মেয়েরাই তো প্রমাণ করে দেয়—
"রং না থাকলেও জীবন আঁকা যায়, যদি হাতে থাকে সাহসের তুলিরেখা।”

12
787 views